নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ প্রতিনিয়ত ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে দক্ষিণাঞ্চল তথা বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আগে যেসব পণ্য ও সেবা নগরে পাওয়া যেত এখন তা উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়েও মিলছে অনায়াসে। বিশেষত হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের বদৌলতে এখন স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই মানুষের হাতের নাগালে। তবে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়গনস্টিক সেন্টার গজিয়ে ওঠায় সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিয়ে মানুষের মাঝে রয়েছে শঙ্কা। আবার ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়গনস্টিক সেন্টার গজিয়ে ওঠায় স্বাস্থ্য খাতে দালাল চক্রের তৎপরতা বেড়েছে। প্রায়ই দেখা যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রোগীদের ভাগিয়ে নেয়ার কাজে নিয়োজিত দালালদের আটকের খবর। অনেক সময় ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিবর্তনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টও তারতম্য ঘটছে। বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।
তবে নানান যুক্তি-তর্কে চাপা পড়ে যায় এসব ঘটনা। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে রাজধানীতে প্রশাসনের তৎপরতায় স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগও। মাঠ পর্যায়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোর কাগজপত্র হালনাগাদের আওতায় আনতে তৎপরতা শুরু করেছে বরিশাল বিভাগীয় ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আবেদনের হিসাব অনুযায়ী গোটা বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় প্রায় সাড়ে নয়শো হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩শ’ প্রতিষ্ঠানের বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। বাকিগুলোর কোনটি লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদন করেছে, কোনটির আবেদন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে কাগজপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, কোনটির সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে আবার কোনটি পরিদর্শনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে কিছু যে আবেদনবিহীন অবস্থায় রয়েছে সে কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
হিসাব অনুযায়ী সিটি করপোরেশন ব্যতীত শুধু বরিশাল জেলায় ১২৭টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৮৬টির। বাকিগুলোর মধ্যে ১৪টি বন্ধ হয়ে গেছে, ১৭টি আবেদনবিহীন অবস্থাতেই রয়েছে। আর আবেদনবিহীনগুলোর মধ্যে মোট ১৩টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলায়।
জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, কাগজপত্র হালনাগাদ বা সর্বশেষ অর্থবছর পর্যন্ত নবায়নকৃত অবস্থায় রয়েছে মাত্র ২৮টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আর বাকি সেন্টারগুলোকে কাগজপত্র হালনাগাদ করতে লিখিত চিঠি দিয়েছে জেলা সিভিল সার্জন অফিস। এরমধ্যে দুই বা তার অধিক অর্থবছর ধরে লাইসেন্স নবায়ন না করা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অভিযোগ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ব্যবসার সাথে স্থানীয় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানকে কঠোরভাবে কিছু বলা সম্ভব হয় না। যদিও বিপরীত সূত্র বলছে, কাগজপত্রবিহীন কিংবা হালনাগাদ বিহীনভাবে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কারো না কারো হাত ধরেই দিনের পর দিন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টিকে মুখ্য হিসেবেই দেখা হয়। অপরদিকে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩৯টি বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতাল রয়েছে, এরমধ্যে ১১টির লাইসেন্স আছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৭টির সরেজমিন পরিদর্শন কার্যক্রম শেষ হয়েছে, ১টি পরিদর্শন কার্যক্রম অপেক্ষমান রয়েছে। বাকিগুলোর আবেদন বিবেচনাধীন রয়েছে।
সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১৬টি বেসরকারি ল্যাব-ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, যার ২৮টির লাইসেন্স রয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে ২১টির পরিদর্শন কার্যক্রম শেষ হয়েছে, ১টি পরিদর্শন কার্যক্রম অপেক্ষমান রয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগেরই আবেদন থেকে শুরু করে অনুমোদন পর্যন্ত কোন না কোন জায়গাতে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সার্বিক বিষয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের বৈধতার জন্য বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন। আর স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তাদের লাইসেন্স পেতে হলে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবকিছু যাচাই-বাছাই করে লাইসেন্স দেয়। সে ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে কারো কিছু করার থাকে না। আর যারা আবেদন করেনি কিংবা কাগজপত্র নবায়ন বা হালনাগাদ করেনি তাদের তালিকা করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সবকিছু যাচাই-বাছাই করতে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি কমিটি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) মো. মাসুদ রেজাকে প্রধান করে সিভিল সার্জনের প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটিটি করা হয়। তারা মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনদের প্রধান করে কমিটি রয়েছে বলে জানান ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল। কমিটির কাছ থেকে হালনাগাদ তথ্য পেলে অনুমোদনবিহীন ও অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস।
Leave a Reply